বিনিয়োগ না করে ফিরে গেছে স্যামসাং

রুলস অব অরিজিন বা উৎসবিধি শর্ত শিথিল করা হলে কোরিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। বর্তমান বাংলাদেশি পণ্যে ৪০ শতাংশের কম কাঁচামাল স্থানীয় উৎস থেকে জোগান দিলে কোরিয়ায় শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়া যায় না। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রপ্তানি বাড়ছে না। তাই এ রুলস অব অরিজিনের শর্ত শিথিল করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এক সংলাপে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ কথা বলেছে। এর সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণকারী বাণিজ্যমন্ত্রী ও ব্যবসায়ীরাও একমত প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও কোরিয়ার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (এফটিএ) চুক্তি করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। স্থানীয় এক হোটেলে ‘কোরীয় উন্নয়ন অভিজ্ঞতা: বাংলাদেশের অনুকরণীয়’ শীর্ষক সংলাপটি যৌথভাবে আয়োজন করে সিপিডি ও ঢাকায় অবস্থিত কোরীয় দূতাবাস।
এ সময় বিনিয়োগের জটিলতার কথা জানিয়ে বাংলাদেশে কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সুং বলেন, সরকার চট্টগ্রামের কেইপিজেডের জমি ইয়াংওয়ানের নামে নামজারি করে না দেওয়ায় স্যামসাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ফিরে গেছে। স্যামসাং এখন ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।
কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ইয়ানওয়ান বলেন, স্যামসাংয়ের মতো সফল একটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি বাংলাদেশ। স্যামসাংয়ের বিনিয়োগ যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে।
দিনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ও কোরিয়ার ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, সাবেক আমলারা সংলাপে বক্তব্য দেন। প্রথম অধিবেশনে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়, রুলস অব অরিজিনের শর্তের কারণে বাজারসুবিধা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এতে রপ্তানিও বাড়ছে না। কোরিয়ায় যে পরিমাণ রপ্তানি হয়, এর ৮৩ শতাংশই আসে ২০টি পণ্য থেকে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, টি-শার্ট, ট্রাউজার, পাদুকা। এসব পণ্যের পশ্চাদমুখী শিল্প রয়েছে। কোরিয়া যদি রুলস অব অরিজিনের শর্ত শিথিল করে স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল জোগানের হার হ্রাস করে, তবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। কোরিয়ার সঙ্গে এফটিএ করা হলে রুলস অব অরিজিনের শর্ত শিথিল হবে।
এ অধিবেশনে কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনসাং ক্যাং আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে কোরিয়া কীভাবে রপ্তানিমুখী শিল্পনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৭০ সালে কোরিয়ার জিডিপি আকার ছিল ৮২০ কোটি ডলার। আর ২০১৩ সালে জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৪০০ ডলার। গত তিন দশকে কোরিয়া ইলেকট্রনিকস পণ্য, গাড়ি, জাহাজের মতো ভারী শিল্পনির্ভর রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। সত্তরের দশকে বস্ত্র, ছোট জাহাজ, পাদুকার মতো পণ্য রপ্তানি বেশি করেছে। করসুবিধা, জমির সহজ প্রাপ্যতা এবং নমনীয় আইন ও বিধিমালা—এসব সুবিধা দিয়ে কোরিয়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে। এ প্রবন্ধে কোরিয়ার বিনিয়োগ কীভাবে একটি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
আলোচনা: বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিনিয়োগের জন্য জমি-সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, কোনো সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীকে জমি দিলে পরের সরকার ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি হয়েছে, এমন অভিযোগে তদন্ত করে। এতে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা তৈরি হয়। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করা হয়েছে।
কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আহ্বান জানিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্মদ বলেন, এ দেশে সস্তা শ্রম রয়েছে। এ ছাড়া বিশাল বাজারও আছে। এখানে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
সিউল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জায়েমিন লি মনে করেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে কোরীয় বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
সিএসআরে খরচ বাড়ানোর তাগিদ: দিনের অপর অধিবেশনে সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বক্তারা। তাঁরা বলেছেন, দাতব্যের আলোকে সিএসআর না করে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এটা করা উচিত। এ জন্য সিএসআর নিয়ে জাতিসংঘের ‘গ্লোবাল কমপেক্ট’ নীতিমালা অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন।
এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লা আল মামুন।
মেট্রপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি রোকিয়া আফজাল রহমান মনে করেন, করসুবিধা দিলে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সিএসআরে খরচ বাড়বে। সিএসআর শুধু দাতব্য কার্যক্রম নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নে সিএসআরের অর্থ ব্যয় করা উচিত।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজার ঘটনায় সিএসআরের ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ হিসেবে এসেছে। এখন পণ্যের মান শুধু নয়, পণ্যটি কোন পরিবেশে, কোন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে, তাও সামনে এসেছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে সিএসআর আইন করা উচিত। ভারত ইতিমধ্যে এ আইন করেছে।
হেদায়েতুল্লা আল মামুনের মতে, যাঁরা ব্যবসা করবেন, তাঁরা মুনাফার কথা চিন্তা করবেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সিএসআরে ব্যয় বৃদ্ধি করা উচিত।
এ অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন কোরীয় রাষ্ট্রদূত লি ইয়ানওয়ান, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক সোবহান, সাবেক বাণিজ্যসচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। এতে দুটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিউল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জায়েমিন লি ও বাংলাদেশের সিএসআর সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহামিন এস জামান।

Leave a comment